স্বপ্ন আবাসন

সভ্যতার উষালগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের ইতিহাস মূলত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ইতিহাস। আদিম যুগের সেই আগুনের ব্যবহার জানা থেকে শুরু করে হাল সময়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার জীবনকে করেছে সহজ আর মানুষকে করেছে অদম্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে তাই সারা দুনিয়া জুড়ে আর্থিক বিনিয়োগের পরিমাণ কল্পনাতীত। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এই যুগে মানুষের জীবন হয়ে ওঠার কথা ছিল সহজ, সুখের ও উপভোগের। কিন্তু বিজ্ঞানের গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে ক্রিয়াশীল যে দর্শন তা গণমুখী না হয়ে ভোগবাদী ও মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ার ফলে আধুনিক মানুষের জীবনটা হয়ে উঠেছে প্রত্যাশার বিপরীত। আধুনিক মানুষ এখন প্রচন্ডরকমভাবে নিঃসঙ্গ, শেকড়বিচ্ছিন্ন, অসুখী ও অতৃপ্ত। চরম বৈপরীত্য তার চিন্তায় আর কাজে। সম্পদের প্রাচুর্যের সাথে বাড়ছে তাঁর সীমাহীন অভাব। জীবনের যা অর্জন তা উপভোগের নেই কোন অবসর। ফলে সচেতনভাবে যা অর্জন করছে অবচেতনে হারাচ্ছে তারও ঢের বেশি।

আধুনিক মানুষের নগর জীবনের ছবিটা আরো বেশি করুণ। নগরবাসী মানুষের জীবন পুরোটাই এখন খাঁচায় বন্দী, শেকড়বিচ্ছিন্ন, অসামাজিক ও কৃত্রিম। এখানকার শিশুদের নেই কোন আনন্দময় শৈশব। খেলাধুলা, ছোটাছুটি, সাঁতার, সামাজিক যোগাযোগ ও সুস্থ বিনোদন ছাড়াই নগরের শিশুরা বেড়ে উঠছে চার দেয়ালের ভেতর।

অন্ন ও বস্ত্রের পরই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি আবাসন সকলেরই আরাধ্য স্বপ্ন। কিন্তু নগর অঞ্চলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার বিনিময়ে চাকচিক্যময় যে সকল ফ্লাট গড়ে উঠেছে তাতে থাকা ও ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকলেও সুস্থ বিনোদন, সামাজিকতা, মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, জলাধার, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, ইত্যাদি জীবনের অত্যাবশ্যকীয় আয়োজন একেবারেই অনুপস্থিত। প্রকৃতঅর্থে, মানুষের একার পক্ষে এতসব সুবিধা একসাথে নিশ্চিত করা প্রায়ই অসম্ভব। তবুও সুখের খোঁজে অর্থের পেছনে নিঃসঙ্গ মানুষ ছুটছে অবিরাম। অর্থ ও ক্ষমতার পেছনে এই অবিশ্রান্ত ছুটে চলা যতটুকু না জীবনের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি প্রদর্শনবাদীতা ও ধনবাদী সংস্কৃতি আরোপিত পণ্যকেন্দ্রিক সুখের মোহ। আমাদের নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ আজ আমাদের নিজের হাতে নেই। আমাদের জীবনের সকল প্রয়োজন, রুচি, চিন্তা, সফলতা, এমনকি চিন্তন প্রক্রিয়া পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে ভোগবাদী জীবন দর্শন ও সংস্কৃতি। এই মুনাফাকেন্দ্রিক ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষকে করেছে বিচ্ছিন্ন ও একাকী। আর পণ্যসুখের হাতছানি দিয়ে আমাদের শামিল করেছে অর্থ উপার্জনের অন্তহীন এক প্রতিযোগিতায়।

অর্থকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, অমানবিক ও বৈষম্যপূর্ণ জীবন দর্শনের এই সমাজব্যবস্থাকে “স্বপ্ন” পাল্টে দিতে চায়। প্রকৃতপক্ষে সুখী ও আনন্দময় জীবন উপভোগের জন্য যতটুকু জীবিকা ও সম্পদের প্রয়োজন তা বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত মানুষেরই জোগাড় হয়ে যায় সহজেই। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ভোগবাদী সংস্কৃতি মানুষকে স্থির হতে শেখায় না। ভবিষ্যত জীবন, জীবিকা ও সুস্থ জীবনের সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা মানুষকে নিশ্চিন্ত হতে দেয় না।

এই অস্থিরতার ফলে যতই তার সম্পদ বাড়ে ততই সে আরো সম্পদের অভাব বোধ করতে থাকে। অথচ জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা সামাজিকভাবে সহজেই দূর করা সম্ভব। সুস্থ, সুখী ও উপভোগ্য জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল আয়োজন সামাজিকভাবে জোগাড় করা খুবই সহজ ও অর্থসাশ্রয়ী। তাই এমন একটা সমাজ আমরা নির্মাণ করতে চাই যা প্রচলিত অমানবিক ও বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমাদের সুস্থ সুখী জীবন, জীবিকা ও মানবিক জীবনবোধের নিশ্চয়তা দেবে আর মানুষের সামনে আলোর বাতিঘর হয়ে জ্বলবে। তাই আমাদের কাঙ্খিত “স্বপ্ন আবাসন” কে আমরা সাজিয়েছি সুখী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গ নিয়েই। পুরো জীবনব্যাপী সুখ ও সুস্থতাকে কেন্দ্র করে; ভবিষ্যতের জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তাকে জয় করার পরিকল্পনা নিয়ে।

প্রতি ঘরে রান্নার ঝামেলা, প্রতিদিন বাজারের কষ্ট, কাপড় ধোয়ার বিরক্তি, বাচ্চাদের দেখাশোনা লালন পালন ও পড়াশোনার দুশ্চিন্তা, সহজ যাতায়াতের জন্য পরিবহনের অনিশ্চয়তা, বার্ধক্যকালীন নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি কিছুই এককভাবে জোগাড় করতে হবে না স্বপ্ন আবাসনে। শুধুই থাকার জায়গা নয়, সেই সাথে খেলার মাঠ, হাঁটার জায়গা, ফুল ও ফলের বাগান, পুকুর, সুইমিংপুল, সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা, ফার্মেসী, কমিউনিটি রান্নাঘর, সুপারস্টোর, কমিউনিটি পরিবহন, থিয়েটার, লন্ড্রি, কমিউনিটি হল, ডে-কেয়ার সেন্টার, এডুকেশন এইড সেন্টার, লাইফ স্কিল ট্রেনিং সেন্টার, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ইনডোর গেম, লাইব্রেরী, মেডিটেশন সেন্টার, ফিটনেস জোন, সেলুন ও বিউটি পার্লার, আড্ডার স্থান, প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সার্বক্ষণিক আন্তরিক সেবা ও বিনোদন কেন্দ্র- ইত্যাদি সকল কিছু পর্যায়ক্রমে যুক্ত হবে স্বপ্ন আবাসনে। বিশাল জায়গা নিয়ে খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে সুস্থ-সুখী ও আনন্দময় জীবনের জন্য এতে থাকবে সকল আয়োজন। বৈপ্লবিক দিক হচ্ছে, আনন্দময় জীবনের সাথে এতে জীবিকারও দারুণ সমন্বয় থাকবে। প্রকৃত অর্থেই স্বপ্ন আবাসন হবে এক ঝাঁক অসাম্প্রদায়িক, সমাজ সচেতন ও মানবিক মানুষের মিলন কেন্দ্র- যা সকল মানুষের সামনে ধ্রুবতারার মতো আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলবে। স্বপ্নের সেই আবাসন বিনির্মাণে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বপ্ন আবাসনের এই ভূস্বর্গে সকল অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মানুষকে আমরা স্বাগত জানাই।

স্বপ্ন আবাসন।

জীবন, জীবিকা ও জীবনবোধের এক অনন্য রূপায়ণ।